Sunday, January 5, 2014

আমি ইঞ্জিনিয়ার ?

'বড় হয়ে কী হতে চাও'? - কাকু  জিজ্ঞাসা করলেন।
অখিল কাকু আমার বাবার স্কুল এর বন্ধু।  এখন কী  একটা ব্যবসা করেন, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। দু -তিন  মাস বাদে বাদে বাড়ি ফেরেন আর আমাদের বাড়ি তে আড্ডা জমান।

'এন্নজিনিয়ার ' - অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলাম।
এই আট বছরের মাথা টায় ঢোকে না, কথাটার মানে। যে সব খেলনা পাই , সেই ছোটবেলা  থেকে সব এ এক-দুদিন  এ খুলে ফেলি। তাই দেখে বড় মামা একবার বলেছিলেন, 'ছেলে তো বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে '. ওই থেকে মাথায় ওটাই ঢুকেছে। ভালই হয়েছে , সব থেকে কমন প্রশ্নের জবাব ফ্রি তে পেয়ে গিয়েছিলাম।

'বাঃ, কি ইঞ্জিনিয়ার হবি ?'
নতুন প্রশ্ন শুনে , আমি একটু চুপ হয়ে গেলাম।  এর আগে তো সবাই 'ভালো ভালো ' বলে পিঠ চাপড়েছে। কিন্তু এরকম উল্টে প্রশ্ন তো করেনি।  আমার সপ্রতিভ মুখটা চুপসে যেতে দেখে , কাকু কী ভাবলেন , কে জানে। বললেন

'বউদি , ছেলে র ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার খুশি তে এক কাপ চা খাওয়ান '
আমার গোমড়া মুখে হাসি ফিরে এল। নিজের মনে খেলতে লাগলাম।


আজ কুড়ি বছর পরে , শীতের এই সন্ধ্যায় হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। হেসে উঠলাম।
অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে আজকে আমি ইঞ্জিনিয়ার। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে চাকরি করি. মাসের শেষে মোটা টাকা মাইনে পাই।  'সত্যি কি আমি ইঞ্জিনিয়ার ?' - মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন তা খুব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
উত্তর এখনও খুজছি।

ভালো রেজাল্ট নিয়ে নাইন এ উঠলাম। মা -বাবা  খুশি হল , বললো  'কিন্তু এবার মাধ্যমিক এসে গেল. আর খেলে বেড়ালে  হবে না। অনেক পড়তে হবে। স্টার পেতে হবে.'
স্টার পাওয়ার ইচ্ছে র জন্য, বাড়ল টিউশন এর নম্বর। সাইন্স এর জন্য একজন।  আর্টস এর জন্য একজন। তাও সায় দিল না মধ্যবিত্ত  মন। বাঙালির ছেলে, ইংরেজি তে তো কাঁচা থাকবে।  উপায় কি ?
ইংরেজি র আলাদা টিউশন। তাতেও উদরপূর্তি  হলো না। জীবন মানে তো অঙ্ক নিয়ে খেলা।  অঙ্কে ১০০ তে অন্তত  ৮০ পেতে হবে।  তাহলে , নতুন অঙ্কের শিক্ষক।
সকাল থেকে উঠে যুদ্ধ শুরু। লক্ষ্য মার্কশীট এ "নক্ষত্রস্থাপন"। সারা দিনের বেশীটা সময় কাটে টিউশন ই . বাবা-মা এর সাথে  কথা বলার সময় জোটে না।  তাতে কি , তাঁদের ই নক্ষত্র জয়ের স্বপ্ন পূরণ এ আমি নিবেদিত প্রাণ।
সেই ইচ্ছে র সামনে বলি পড়ল জিমন্যস্ট, ক্রিকেটার, ফুটবলার । .. আরও কত ইচ্ছে। 'পড়াশোনা করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে ' - এই বলে কচি মনকে বোকা বানালাম ।
দু - বছর মেতে থাকলাম পড়াশুনোর  নেশায় । অবশেষে এলো পরীক্ষা.. শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মনে শান্তির ছোঁয়া । মনে হলো অনেকদিন ধরে আমায় কেউ অন্ধকার কুঠুরী তে বন্ধ করে রেখেছিল।  আজ অনেকদিন বাদে কুঠুরি এর  বাইরে বেরোলাম , অনেকদিন বাদে দেখলাম ওই নীল আকাশ টাকে..প্রাণ ভরে ফুসুফুসে ঠেসে দিলাম স্নিগ্ধ বাতাস ।

"কি রে , স্টার হবে তো " - হঠাৎ  মায়ের এই প্রশ্নে, কেমন যেন  ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম ।
ঠিক কি উত্তর দেবো  ভেবে উঠতে পারলাম না।  অনেক ভেবে বললাম - " রেজাল্ট বেরোলে বুঝতে পারবে !!"
ভাবলাম তিন মাসের জন্য শান্তি।  আর কোনো প্রশ্নের সামনে  পড়তে হবে না।
ভাবনা টা  সবে মনের মধ্যে চরে বেড়াতে শুরু করেছিল..এমন সময় আবার ছুটে এলো প্রশ্ন ..
"নতুন টিউশন কবে থেকে শুরু হবে??খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করো.. সাইন্স এর পড়া তো আর ছেলেখেলা নয়..!!" প্রশ্নবাণ এ জর্জরিত আমি তখন চারিদিক অন্ধকার দেখছি। বুঝলাম, যুদ্ধক্ষেত্রে আমি নেমে পড়েছি।  এখান থেকে ফেরার কোনো রাস্তা নেই। যুদ্ধ করে যেতে হবে আর এগিয়ে চলতে হবে। থেমে যাওয়া বা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালানোর মত  বিলাসিতা করার ক্ষমতা আমার নেই।

চুপ থাকতে দেখে, মা বলে উঠলো - 'কদিন বিশ্রাম নে , কিন্তু H.S. এর সিলেবাস খুব বড় আর কঠিন তো , তাই তাড়াতাড়ি শুরু করে দেওয়া ভালো '

'আচ্ছা ' - অনেক কষ্ট করে কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো।

এসে গেল ফলাফল এর দিন।  সারাদিন  মন আনচান।  কি জানি কি হবে। যদি ষ্টার না পাই , তাহলে এতদিন যে ফিজিক্স , কেমিস্ট্রি নিয়ে এত পড়লাম, তা তো জলে যাবে।
'আর মেয়েগুলো যে হাসাহসি করবে। এতদিন যাদের সামনে হিরো সাইকেল এ  'HERO' হয়ে ঘুরছিলাম, তাদের চোখে চোখ রাখতে পারব না ' - চিন্তা টা ঘনীভূত হচ্ছে মাথায়।
অগত্যা উপায়- আমাদের মত মিডিওকার ছেলেদের একমাত্র ভরসা 'জয় বাবা লোকনাথ '. লোকনাথ বাবা কে ব্ল্যাকমেল করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম , কে জানে।
'বাবু , বাবু ' ডাক শুনে হটাত উঠে বসলাম বিছানাতে।  বাবা ডাকছে।
মনটা ভয়ে আঁতকে উঠলো। ঘর থেকে বেরলাম।
'মনে হয় , রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। যা , কম্পিউটার এ দেখে আয়ে' - এই বলে আমার হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিল.
কম্পিউটার এ রেজাল্ট দেখার দক্ষিনা ।
Hi speed লাব-ডুব এর তাড়ায়  মনটা তখন  নেহাত ই বেহাল.. অতঃপর মস্তিস্ক চালিত হয়ে ,মুখ-হাত ধুয়ে রোল নম্বর নিয়ে লোকনাথ বাবার ভরসায় চললাম  'STAR 'কুড়োতে ....

বাবা লোকনাথ কে ব্ল্যাকমেল করেই হোক কি আমার দু' বছর এর খাটনি তে,বাবা-মা এর প্রথম লক্ষ্যটা পূরণ হয়েছে,ছেলে স্তর পেয়েছে...
'যাক , বেঁচে  গেলাম। মাথা লুকিয়ে চলতে হবে না '... আমি ও খুশী ওদের মুখের চওড়া হাসি দেখে।
"জীবনযুদ্ধ" -এর  প্রথম ধাপটা মোটামটি ভালো ভাবে পেরলেও , সামনে যে বড় খাদ।
এতদিন boy's স্কুল এ নিজেদের মত বাউন্ডুলে ক্লাস আর নেই...প্রথম বার মেয়েদের সাথে ক্লাস করা , নতুন নতুন মেয়ে বন্ধু ,যাকেই দেখি কিশোর চোখে সবাই সুন্দর..- সঙ্গে কত অজানা অনুভূতি, কত মুনি ঋষি এর মাথা ঘুরে যায়...আর আমার মত এক সমান্য ছাত্র এর পক্ষে এত সব কিছু ওই  কৈশোর এ সামলানো তো আর চাট্টিখানি  কথা নয়।
কিন্তু আমি লক্ষে অটল।  বাবা-মা  র মুখের হাসিখানি তো বজায় রাখতে হবে...বার বার ফিরিয়ে আনতে হবে।
কৈশোরের লোভনীয় ডাক উপেক্ষা করে...মন আর মস্তিস্কের অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ,হাজির হলাম আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু এবার আর আগের মত অতটা সহজ নয়,এক এক দিন  ছ-ঘন্টা ধরে সাদা কাগজের উপর অনেক নতুন-পুরনো equation লিখলাম।
"উচ্চ-মাধ্যমিক" শেষ হলো.....ভাবলাম এবার কিছুদিনের মুক্তি...খেলাধুলো আর নিজের মত থাকার শান্তি.. মা ও কোনভাবে আগেরবারের মত ওটাকে মারতে পারবে না। কারণ রেজাল্ট অব্দি এখন আর কোনো চিন্তা নেই।
কিন্তু এবারের অনুভূতি তে  আনন্দের মধ্যেও কেমন যেন বিসন্নতার ছোঁয়া।এই বার এর রেজাল্ট এর সাথে  যে যার মত জীবনের স্রোতে বয়ে যাবে।এই বন্ধু বান্ধব.. সবাই একসাথে সেই পুরনো জায়গা  এ সব আর ফিরে আসবে না...সবার সাথে একই ভাবে মিশতে পারব না।
ছাদে ঘুরতে ঘুরতে এই সব হাবিজাবি ভাবছি , এমন সময় দরজা খোলার শব্দে পিছু ঘুরলাম।
"কিছু খাবি?" - মা এর আগমন।
মাকে দেখে বিসন্ন মনটা কেমন জানি আর ও দুঃখী হয়ে গেল. মাকে ছেড়ে থাকতে হবে, এই ভাবনায় ।শুধু বললাম
"না"
মা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো
"এবার তুই দুরে চলে যাবি। কতদিন পর পর বাড়ি আসবি কে জানে' - দেখলাম  চোখ থেকে দু-এক বিন্দু ছাদে পড়ে শুকিয়ে গেল.
দুঃখী মন টা আরো বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে গেল....চোখের জল কে কোনো ভাবে আটকে, ভারী গলায় বললাম
"কেন, আমি তো এখানেও পড়াশুনো করতে পারি। বাইরে যেতেই  হবে কে মাথার দিব্বি দিয়েছে "
মা ঠাট্টা টা বুঝে, মুচকি হেসে বলল
"না না। এখানে পড়াশুনা হয় না........ জয়েন্ট কবে যেন তোর্ ?"
অভিপ্রেত টা বুঝে, মনের মধ্যে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম
"যাচ্ছি"
ছেলেবেলায় "ইঞ্জিনিয়ার  হবো" বলাটাকে ছেলেমানুষী হিসেবেই ভেবে এসেছি..তাই ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না।আমার চোখে তখন  ম্যাথেমেটিশিয়ান বা সায়েন্টিস্ট হবার স্বপ্ন।
সুতরাং জয়েন্টটা কে সিরিয়াসলি নেওয়ার প্রশ্ন ই ওঠে না... বাবা র জন্য ফর্ম ভরা।
 টিফিন এ বাবার পকেট কেটে বেশ জমিয়ে খাওয়া হত।  বেচারা বাবা, ছেলে জয়েন্ট দিচ্ছে তাই কিছু বলতেও পারত না।হেসেখেলে জয়েন্ট শেষ হলো.
ঘুরে-বেড়িয়ে, আড্ডা মেরে তিন তিনটে মাস যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
জয়েন্ট এর রেজাল্ট বেরোনোর খবর শুনে , বাবা-মা টেনশন এ পড়ে গেল। আমার কোনো হেল-দোল নেই।
পরেরদিন দুপুরে ঘুমিয়ে আছি, এমন সময় মা এর চেঁচামেচি তে ঘুম ভেঙ্গে গেল. বুঝতে পারলাম অনেকক্ষণ থেকে আমাকে ডাকাডাকি হচ্ছে।
"কি হলো" - সুখের দিবানিদ্রায় বাধা পড়ায় বিরক্তি প্রকাশ করলাম
"রেজাল্ট বেরিয়ে গেল, আর এই ছেলে দেখো কুম্ভকর্ণের মত ঘুমচ্ছে " - মা রেগে বলে উঠলো।
"রেজাল্ট বেরিয়েছে তো কি করব. নাচব?" - ঘুমের ঘোরে প্রত্যুত্তর।
"যা, বাবা। দাদা কে ফোন করে জেনে নে " - মা এর সুর নরম হলো.
দাদা, মানে আমার একমাত্র মামা। কলকাতা তে সরকারী চাকরি করেন।
বুঝলাম, ছাড়া আমি পাব না। আমি জানতে না চাইলেও আমাকে জানানো হবেই।উপরন্তু হাজার রকম কথার উত্তর দিতে হবে..তাই নিজে থেকেই জেনে নেওয়া ভালো।